জড় হয়ে আছি

জড় হয়ে আছি

০১

যে শব্দ অপেক্ষা করে তাকে ভুলক্রমে হাতে নিয়ে—

বসে আছি, সময়ের হিসাব ভুলে অন্ধের মতো

দূরতম সম্পর্কের কাছে, কার হাত জেগে ওঠে

তুমি তার ছায়া হয়ে ক্রমশ আড়ালে চলে যাচ্ছো

এ’ দৃশ্যের ভার চোখ থেকে যেন ভেসে আসে নদী

যেন শব্দকুঞ্জভার—তোমাকেও নিয়ে চলে যায়

ক্রমশ বুড়িয়ে যাই, বুঝি; এই পৃথিবীর কোণে—

সবকিছু হাতে নিয়ে ক্ষয়ে যায় এই সমগ্র জীবন

এ কেমন অর্থহীন মরে যাওয়া, কেউ জানে না

তুমিও কি জানতে না? সমগ্র দুয়ার বন্ধ করে

কোন সে মায়ার গান তুমি আনমনে গেয়ে যাও?

যে ব্যথার রূপ দেহে ও বল্কলে ছিঁড়েখুঁড়ে দেয়

তার কাছে পৃথিবীর সকল প্রেম হারিয়ে যায়!

০২

সব কিছু ঝরে যায়, থেমে যায় বর্তুল পৃথিবী

সকল মুহূর্ত তাই, ক্রমে ক্রমে চলে যায় দূরে

যেন চিরস্থায়ী খরা, অনাবাদী মাঠের কিষান

এই বিপুল পৃথিবী কী করে একাকী হয়ে যায়

যেমন শেষ দেখার আগে, চেয়ে থাকে অপলক

এ’ দৃশ্যের মুখোমুখি সমস্ত শূন্যতা ভর করে—

যেভাবে নিশ্বাসে জমে থাকে শব্দ- কুহকের গান

তুমি কি জেনেছো, দৃশ্য থেকে হারিয়ে যাওয়া কেউ—

সমস্ত বিস্মৃত সন্ধ্যা হয়ে ঝরে গেছে অকাতরে

জীবন আলাদা হয়, অজস্র ক্ষয়ের ইতিহাস

ধরা দেয় রোমকূপে—খসে পড়া তারাদের সাথে।

০৩

তোমার চোখে যে আলো, সে দ্যূতি পাইনি কোনদিন

সে আমার জন্য নয়, এ’সত্য জাগ্রত হয়ে থাকে—

আমার চোখের কাছে—সকল জানালা-দরোজায়

তবু কেন গান বেজে ওঠে? ধমনীতে, ভাঙা স্বরে?

তারে পারিনা এড়াতে—ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো—

ছুটি এদিক-ওদিক। জানি, এ’সত্য পুরনো হবে

যেভাবে পুরনো হয় পরনের কাপড় ও ঘর

চায়ের পেয়ালা জুড়ে, যতটুকু স্মৃতি জমে থাকে—

তারচেয়েও নিঃস্ব মনে হয়! মনে হয় সত্যটুকু

ঘড়ির কাঁটার মতো পাল্টে দিতে। যদিও সকল—

কথা ছুটে চলে যাবে সময়ের নিস্তরঙ্গ পথে

যেখানে সকাল আসে, এই জড়-মৃত্যু ভালোবেসে।

০৪

তুমি কি ছুঁয়ে দেখেছো, এই বিপুল জলের ফেনা?

আকাশরাশি? বস্তুত যা কিছূ মিলিয়ে যায়, তুমি

তার হাত ধরে চলে যাও অলক্ষ্যের পানে, দূরে

না দেখাতেই নিশ্চিন্তি-যেন পুনর্বার বেঁচে উঠি

তীব্র অন্ধকার এসে ভর করুক আমার চোখে

কেবল ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখবো আমার বন্ধুদের

তোমার নিত্য অস্তিত্ব মিলিয়ে যাবার মতো এই

অমীমাংসা, নিয়ত নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের কোণে

আমি ভুল করে বসি—ভুল গান গেয়ে উঠি কেন?

এই অগস্ত্য যাত্রায়, দৃশ্য ও পরিদৃশ্যে, অগাধ

জলরাশি এসে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাকে

যেন কোনদিন ভেসে না ওঠে বিস্মৃতির ওপাড়ে।

০৫

কীভাবে যাবো জানি না এই শহরের গান থেকে

তোমার শব্দের মতো একাকীত্ব ছেড়ে দূর পথে

যেখানে নেই এমন ঘর যে আশ্রয়প্রার্থী হবো

তবুও, অতি আগুনে ঝাঁপ দেয়ার আগে নিতান্ত–

গোবেচারা প্রেমিকের মতো একবার ডুব দিতে

চাই। অন্তত দৃষ্টির যাতনা থেকে বাঁচতে চাই

অথবা এমন ক্ষয়ে যাই খুচরো জীবন থেকে

যে সমুদ্র আঁধারের মতো বুকে বয়ে নিয়ে যাই

তার সঙ্গে একা হেঁটে কতদূর যেতে পারি আমি?

এমন দ্বিধাহীনতা, এ’শহরের কোলাহলের

মতো ক্লান্ত ক্লান্ত করে। যেনবা ভুল করে দাঁড়িয়ে

যে পথে আকাশসারি নেমে আসে রাশি রাশি মেঘে

আমি তার যাত্রাপথে কিছুটা মায়ারঙ বিছাবো

জানি, কখনোই দেখা হবে না তার প্রেম-লাবণ্য।

০৬

তোমাকে পেতে চেয়েছি সহজ মতে। অথচ জানি

মৃত ফসিলের বুকে যে শস্যরেখা, তা অবিরল

তোমার মুখের দিকে ছুটে যায়, যেন মায়াজাল

যতটুকু চাই, তার চেয়ে বেশি দূরবর্তী করে

এমনই ভাগ্যরেখা! কাছে থেকে যোজন দুরত্বে

ঠেলে নিয়ে যায় শুধু, যেন এ’আমার প্রাপ্য নয়

কত ছায়ার আড়ালে আমি যেনবা গুটিয়ে যাই

যেমন শীত কুন্ডলী, উষ্ণতাহীন দিনগুলোতে

যেন সে অভিযোজনে, সিদ্ধার্থের চন্দ্রাহত যাত্রা

কত জন্ম পেলে তবে আমি তোমার আঙুল ছোঁবো?

০৭

অবশেষে ঝরে যায় সকল বকুল, আলপথে

শিশিরের শব্দকণা আর সমুদ্র যাত্রার গান

দূর কোনো নক্ষত্রের ছায়া হয়ে থাকে অগোছালো

শব্দের তীব্র নিশ্বাস। নজরবন্দী এই জীবনে

মুহূর্তগুলো কাচের মতো ভেঙে পড়ে বারে বারে

এখনও মাঝরাতে শুনতে পাই দীর্ঘ উড়ালে

যে পাখিরা চলে গেছে, ঘর ছেড়ে মৃত্যু ভালোবেসে

তাদের দীঘল কণ্ঠে বাজে মৃদু জীবনের গান

যারা ফিরে আসে তারা কি এখনো মুখোমুখি হয়–

সে সকল শব্দকণা, যারা একদিন তীব্রস্বরে

গেয়ে উঠেছিলো গান এই তীব্র মিলন বিরহে?

জানি, সকল বিরহে শুধু আত্মপ্রবঞ্চনা থাকে!

০৮

এখনো আসেনি কেউ, আমি দাঁড়িয়ে আছি একাকী

এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো শহরে। ঘন্টা বাজছে

যেন শেষ বিদায়ের শ্লোক, মন্ত্রধ্বনি বেজে ওঠে

সমস্ত শরীর যেন অনন্ত যাত্রার গান এক

এই উন্মাদ হারিয়ে যাবে আনকোরা হাওয়ায়

পুরনো চিঠির ভাঁজে, সকল আশঙ্কারা হারাবে

এক নক্ষত্রের জ্বরে পুড়ে যাবে সমগ্র পৃথিবী!

পাগল! জড়ো করছে পৃথিবীর সমস্ত সম্ভার

আমি টের পাই তার অমীমাংসিত পথরেখা

মিলিয়ে যাবার আগে খুলে যায় কোমল আঁধার…

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Written by
সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Join the discussion

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
সৈয়দ সাখাওয়াৎ

সৈয়দ সাখাওয়াৎ

জন্ম ৮ আগস্ট ১৯৭৮; চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।