পাথর এক

কোথাও পাথর এক, বুকজুড়ে নিয়ত নিশ্বাস
আরও গভীর হয়, আরও অর্থহীন গহ্বরে–
ডুবে যায়, যেন এক অন্ধকার সকলের বুকে
বারবার ফিরে আসে–দ্বিধা ও অস্বস্তি ভালোবেসে
হাতের স্পর্শে যেনবা সেইসব ছায়া পড়ে থাকে
শূন্যতার তীররেখা ধরে ফিরে আসে কেউ বুঝি
বুঝি এমন বিপন্ন–যেন সর্বনাশের শরীরে–
অগ্রন্থিত চিৎকার গড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে
পাতার আকরে যেন তারা ছিলো এতটা প্রবল।

আমরা পরস্পরকে দ্যাখি কতটা সজল চোখে
কতটা মায়ার ছায়া আমাদের ওষ্ঠে লেগে রয়
অন্ধকার খুব কাছে ছিলো, ছিলো বেদনা বাহার
ছিলো আনন্দ, বিরহ তাকে ছুঁয়ে ছিলো তবু যেন–
ফুরায় না তবু, এই গান ছুঁতে চায় কা’র কণ্ঠস্বর?
কা’র বুকে সেইসব পাথরের মায়া পড়ে আছে
কোথাও জলের আভা, কোথায় হয় উৎসারিত
আমরা শুধু শুনেছি কান পেতে, আমাদের দিন–
হাতের পরশ থেকে দূরে কোথাও হারিয়ে গ্যাছে।


এরকম অন্ধকার নেমে আসে বুকের ওপর
গভীর নিশ্বাসে যেন শুনি তার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
এই অন্ধকার থেকে আলোহীন শরীরের রেখা
চলে যায়– আমাদের দেখা হয়না এখন আর।
কেবল শব্দহীনতা খেলা করে, কেবল শূন্যতা
গভীর গহ্বর যেন, নেমে আসে গাঢ় জলরেখা
জানি না কত গভীরে রুয়েছে সর্বগ্রাসী ব্যথারা
পূরণের আশীর্বাদে কতটুকু স্পর্শ করি তাকে?
নিজের হাতে বয়েছি প্রতিশ্রুত বেদনার ভার
শব্দহীন পৃথিবীর গান, ভেঙে পড়ে বারে বারে
যতটুকু দৃষ্টি যায় পতনের গাঢ় অন্ধকার
থেকে থেকে ফিরে আসে,আর কেঁপে ওঠে হাওয়ায়।


এত অন্ধকার তবু আমার শরীরে মেশে যদি
যদি ঘুমের গভীরে নেমে আসে মৃতপক্ষ রাত
সমস্ত আঁধার বুঝি নেমে আসে প্রবল মুহূর্তে–
তবে কী করে ঘুঁচাবো এ’পাথরের প্রবল ভার?
তবু তোমার দিকেই আমার এ’অলক্ষ্যের যাত্রা
আর সকল স্তব্ধতা গান–বেজে ওঠে পারাপারে
প্রতিটি মুহূর্ত যেন নিয়ে আসে শীতল হাওয়া
জড় করে, আমাদের হাড়ের গভীরে বীতশোক।
তবে কি তোমার দিকে ছুটে যায়নি আমার ভাষা?
না বোঝার ভীড়ে কি তবে হারিয়েছে সবকিছু?
এইসব অন্ধকার আমাকে কেবল অন্ধ করে–
তোমাকে দেখার মতো শেষ আলোটুকু নেই যেন!


শিল্পের মাধুর্য্যে গড়া তুমি, কেন পিছনে তাকাও
কেন ভেঙে পড়ো, কেন এই আলপথে ফিরে আসো
শূন্যতায় কেন খুঁজো চলে যাওয়া পাখির গান
তুমি তো আকাশ ভরা অনাঘ্রাতা আলোর শরীরে
চির শ্রাবণের দিন নিয়ে ফিরে ফিরে নেমে আসো
এই মলিন কণ্ঠের ভার যেন দূর যাত্রাপথে—
কোন শেষ নেই যেন—যেমন কোথাও নেই শুরু
শুধু এই ভোরলগ্ন জীবনে, নীরব প্রান্ত ছুঁয়ে—
ক্রমাগত বুনে যাও অশরীরী দুখের বুনন
চোখে রাখো অন্ধকার—চির পিপাসার গাঢ় বন
অথচ তোমার চোখ, আলোকের উৎসব যেন
পাথরের নীরবতা ভেঙে জেগে উঠতে পারতো…


কত কথা বলা হয়, তবু বলা হয়না কিছুই
বিষণ্ন পাহাড়শ্রেণি অবিকল তোমারই মতো–
দাঁড়িয়ে–বুকে গোপন অস্বস্তি–বেদনার মতোই
নিজেকে বিক্ষত করো–চোখের নোনা জলে নিয়ত

এরচেয়ে আর বেশি কীই-বা দিতে পারে পৃথিবী? —

কোনদিন মেঘহীন এই আকাশে মৃদু আলোতে
চোখে নেমে আসে যদি বিপুল শূন্যতা–হাহাকার
টেনে নিয়ে যায় যদি আরো দূর কোন শূন্যপথে
কীই-বা হারাবে বলো–যদি নাই-বা জানলে আর?

চোখের অস্ফুট নদী, নিয়ে যাবে দূর যাত্রাপথে…

পাথরের ব্যাধি নিয়ে তন্দ্রাহীন মানব জীবন
কেবলই দীর্ণ করে–করে তোলে দুঃখপ্রবন!


কারো অপেক্ষায় থাকে কেউ,থাকে বাষ্পরুদ্ধ চোখে
হৃদয়ের ঘনঘোরে–মিথ্যের বেসাতি সংসারে
মায়ার জটিল জলে–হাতভরা ক্লান্তির ছায়ায়
একদিন জেনে যায়, পাথর গড়িয়ে গ্যাছে দূরে
দাঁড়াবার শেষ স্থানটুকু ফুরিয়ে গ্যাছে কবেই
তবু তার নির্ভেজাল চোখ দণ্ডকারণ্যে হারায়
যেন এইটুকু মায়া অবশিষ্ট ছিলো–হারাবার
যার কোনো ঘর নেই, ফুরিয়েছে পাতাদের গান
তার হাতে জমে শুধু শেষ বিকেলের অভিমান
যেন সে কাছেই ছিলো– আলগোছে হারিয়েছে নদী
পাহাড় চুড়ায় তার আবছায়া আজো পড়ে আছে
একটি পালক রেখে, যে পাখি চলে গ্যাছে উড়ালে
ডানায় নরম রোদে– আজও সে গল্প লেখা আছে।


তৃষ্ণায় যে মরেছিল, খুলেছিল হৃদয়ের খাম
সারারাত আলো জ্বেলে–ফুরিয়েছে ঝড় ভালোবেসে
তৃষ্ণার আনন্দ যদি হয় নদী, দুঃখের কী নাম?

আরও দূর যাত্রায়–যেখানে শব্দেরা ক্রমে ক্ষীণ
যেখানে শোকের আয়ু, জেগে থাকে সমুদ্র যাত্রায়
বাতাসের মানচিত্রে তার ছায়াগুলো অমলিন…

অথচ নদীর নামে, যে শব্দ নেচে ওঠে মগজে–
তাকে এখনো প্রেমিকা ডাকে, সাজায় ব্যর্থ ঐশ্বর্যে!

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Written by
সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Join the discussion

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
সৈয়দ সাখাওয়াৎ

সৈয়দ সাখাওয়াৎ

জন্ম ৮ আগস্ট ১৯৭৮; চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।