প্রেমসম্ভবে

প্রেমসম্ভবে

সৈয়দ সাখাওয়াৎ

১.
যদি না কাছে আসো, যদি না মাতাল হাত বাড়াও
অনুঢ়ার রাগ, না ভাঙে যদি আদরের সীমানাটাও
তবে কেন এই বসন্ত ব্যকুল হয় দূরগামী মেঘে
এই বিরহকাল কেন তবে পুষে রাখি মরাল চোখে?

বুকে তবু ধাতব নিশ্বাস জমে জমে হয় গমের বীজ
উদগমের অপেক্ষায় আর কতকাল কেটে যাবে
তুমি কি সকাল নদী সন্তান আকাঙ্ক্ষার তাবিজ–
কা’র হাত ধরে কাটাও সমূহ আকাল: প্রেমসম্ভবে?

এতো এতো সাড়াহীন দিনগুলো মুছে চলে গেলে
আমার ক্ষত্রিয় বুকে এখনো সূর্য উঠে জ্বলে…

২.

নীরবতা গুনগুনিয়ে বাজে–
ভুল বুজেছো,
খুব নীরবে লুকিয়ে গ্যাছো কাজে
আমি না হয় আকাশবাণীর গানে 
শুনছি তোমায় খুব গোপনে
যেখানে মেঘ থমকে গ্যাছে বৃষ্টি নামবে বলে…
আমার না হয় চোখ পুড়েছে, বিষন্নতায় বুক জুড়েছে
তুমি কেন ওপার থেকে হাত বাড়ালে না?
শহরজুড়ে গল্প ছিলো, এক প্রহরে পা হারালো
অনেককিছু হারিয়ে যাবার ছলে…
এক জীবনে অনেক হলো হৃদয় দিয়ে হৃদয় গাঁথো
সময় হলে এক প্রহরের সঙ্গী করে নিও
আর না হলে কী আর হবে
মেঘের মতো ফুরিয়ে যাবো
মৃদুমন্দ বাতাস যখন তোমার কথা বলবে…

৩.

এ’ কথার মানে পুরনো হয়েছে আগেই
তবু বলে যাই হৃদয় গাইছে বলে
জানি এ’ বাক্য তোকে বলা হয়ে গেলেই
পাপড়ির মতো বুক খুলে যাবো চলে।

রোজ ভোরবেলা তোর মুখ ভাসে চোখে
চোখ বুজলেও পাতা তিরতির কেঁপে যায়
প্রসঙ্গ ভুলি, বলা তো যায় না তোকে
বাদামী চোখের দৃষ্টি ভুলি কী করে হায়!

প্রতি সন্ধ্যায় বুকের ভেতর জল
প্রতি রাত তবু বৃষ্টি মুখর হয়
তোর কাছে যায় নিঃশব্দ কোলাহল
যে কথা বলতে বুকে জমে সংশয়।

এ’ কথাটি বলিনি ব্যকুল স্বরে
মাঝ বয়সে তোর নামেরই পাড়া
সাজিয়ে রাখি সহজ নদীর পাড়ে
কূল ভেঙে পড়ে — হৃদয় বাস্তুহারা!

৪.

আকাশজুড়ে মেঘ জমেছে মন খারাপের দিনগুলো
কা’র কাছে যাই, কোন বাহানায় সময়টুকু একলা যখন
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে শুধু ঘর পালানো পথের ধুলো
তোমায় আমি ডাকতে চেয়েও মুখ ঢেকেছি সারাটাক্ষন

তবু এই বুকের ভেতর হাজার কথার পাহাড় জমে
অথচ নেই সঘন প্রেম শুনতে চাইবে সেসব গান
না দেখার এই জোয়ার-ভাটায় দুঃখ বাড়ে ক্রমে ক্রমে
আমার আকাশ মেঘলা হলেও তোমার আকাশে বাজুক প্রাণ

আমার শুধু চোখের ভেতর বিষণ্ন এক স্বপ্ন নাচে
শব্দনদী ফুরিয়ে যায় আরও ফুরায় আকাঙ্ক্ষাটাও
স্বপ্নে শুধু পাহাড়সারি রাতের বুকে শরীর সেঁচে
মনের ভেতর তবু যেন ফিরে আসে অবাধ্যতাও

৫.

অথচ তোমাকে ভেবে ভেবে কত রাত হলো ভোর
তবুও তোমার দিকে যাওয়া হয়নি এখনও
যেনবা সূর্যাস্তকালে সমুদ্রের জলের উপর–
যেভাবে ডুবে যায় আগুনরঙা আলো, ঠিক যেন–
তারই মতো তোমার দিকে যেতে যেতে ডুবে যাই
এমনই ভাগ্যরেখা, সমুদ্রের জলও পারিনি —
হতে–অথচ নিয়ত ডুবে যাচ্ছি এ’খরা-বন্যায়
গ্রহণের দিন থেকে আজো কোন আলোক আসেনি!
নির্ভার কোন ফুলের দিকে, যখনই তাকিয়েছি
ভেবেছি–এ’শুধু ফুল নয়, তার সমগ্র জীবন–
কেটে গ্যাছে ফোটবার অপেক্ষায়। নিজেকে সঁপেছি–
তোমাকে ফোটাবো বলে, চির অপেক্ষা, বন্যাপ্রবন…

৬.

মেঘ জমে প্রতিদিন, এমন নতুন কিছু নয়
ভ্রমণের দিনগুলো শেষে আসে পাতা ঝরা দিন
যেমন আজকে বৃষ্টি, আজ মন খোয়ানোর ভয়
উদ্বাস্তু মেঘের সাথে হয়ে উঠি ক্রমশ নবীন

৭.

স্বপ্ন তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে আলোকের মতো
মন্থর মেঘের রাতে ঝরে পড়ে ধূমকেতু দূরে
মনে পড়ে সন্ধ্যাগান, মানুষের মুখ ইতস্তত
যারা চলে যায় হাত ছেড়ে ছায়ার মতো শরীরে
কিছু স্বর তবু থেকে যায়, কিছু রাগ-অভিমান
কান্না-হাসির মেহেক, শুকিয়ে যাওয়া ফুলগুলো
অথচ স্মৃতিরা থাকে–শব্দেরা যেখানে করে স্নান
আসা-যাওয়ার স্রোতে যে’কথা পরস্পরকে বলো
কতটা গভীর চোখে মেঘ আসে–বৃষ্টিও কখনো
নক্ষত্রের রাত, তীব্র দোঁহার যখন বেজে ওঠে
যেসব পালকে মুছে নেয় নদীও হয় বিষণ্ণ —
তার ছায়াঘন পথে সুর বাজে নিহিলের কণ্ঠে
ছুঁয়ে থাকে অন্ধকার, আমাদের ব্যথামগ্ন রাত
পরস্পরের আঙুল, দূরবর্তী আলোকের রেখা
কতটা ব্যকুল হলে ফিরে আসে নির্জন হাত
নিদ্রার ভেতর যেন কেঁদে ওঠে–অমা অশ্রুলেখা।

৮.
অপেক্ষায় বসে আছি, কেউ এসে সাথে নিয়ে যাবে
আজ সবকিছু ঠিক গুছিয়ে রাখবো ঠিকঠাক
কোথাও পাতা ঝরার গান বেজে যায়–নীরবতা
ছুটে আসে মেঘদল, ঝরে পড়বে বৃষ্টির ডাক
ততক্ষণ ভিজে যাবো, যতক্ষণ হাতে নেবো জল
সন্ধ্যের উৎস থেকে আলো আসে আলুথালু চোখে
আর ভিজে যায় স্বপ্ন–বেদনার কত কত স্তর
ধুলো জমা পথটুকু শেষমেশ অভিন্ন সহগে–
ফিরে যাবো যতটুকু আলো নিয়ে ডুবে যায় চাঁদ
খোলা মাঠের আঁধারে ডুবে যাবে ঘাসের ফড়িং
আমিও কী ডুবে যাবো অপেক্ষায়–নিশীথ ছায়ায়?
তোমার অভাব বুঝি শিখিয়েছে–সময় প্রমাদ।

৯.

এখনো তোমার চিঠি খোলাবুকে জ্বলে উঠে যেই–
এখনো কৈশোর স্মৃতি–অ্যাড্রিনালিন চমকাচ্ছেই
আজও সকালবেলা বালিশের কাছাকাছি কেউ
পাঁজরে দারুণ স্রোত, থামে বৃষ্টির গতিধারাও
থামে বাক্সবন্দি রোদ, সকালসেঁচা ইচ্ছের বাড়ি
মাঝবয়সের রোদে–এখনো নিতান্তই আনাড়ি
আশ্চর্য রোদের রঙ, আশাবাদি মেঘের সুবাসে
বাদামি গমের বীজ বেঁচে ওঠে গভীর নিশ্বাসে
তুমি তো বাক্সেই বন্দি, বুক অব্দি ডুবে আছো জলে
আমিও বেঁধেছি বুক–তোমাকেই ডেকে যাবো বলে

১০.
আমি তো তোমার কাছে হাত পেতে নিয়েছি সুদিন
তোমার সৃষ্টির কাছে এইসব আলোঝরা রঙ
আমিও খুলেছি দোর, জানালার সকল কপাট
হৃদয় ছাড়া এমন কিছু নেই যে দেবো তোমায়
তবু জেনো, এই রিক্ত এলোকেশী জীবনের বাঁকে
তোমার আঙুলে বেজে ওঠা পদ্মের মৃদু কোরক
আমার দুচোখে যেন জ্বলে ওঠে শতাব্দীর আলো
যে নক্ষত্র আকাশের বুকে–জাগে–ভোরের আভায়
আর সমূহ পাপড়ি ঢেকে দ্যায় কোমল আলোয়
কী নামে ডাকবো বলো? হাতের পরশে টের পাই–
চলে যাবার সময়ে, তুমি যেন আরো কাছে আসো…
তবু চলে যায় দিন–মনে পড়ে প্রবল প্রহরে–
বৃষ্টিমগ্ন দিনগুলো তোমার রূপেই ফিরে আসে
আর ছায়াহীন দিনে, তুমি যেন প্রশান্তি আমার…
তবে কি প্রতিদিনই তুমি? মূহুর্তেরা তুমিময়?
আঙুলের প্রতিবেশি হয়ে ফোটাও নির্ভার ফুল…
১১.
এমন অনেক দিন কাটে না রাত কাটে না, একলা লাগে
জানি তোমায় এ’কথাটি বলতে অনেক দ্বিধা
আমার না হয় একটা জীবন কাটলো কেবল একাই জেগে
তুমি শুধু মধ্যযামের ব্যর্থ হাওয়া থামিয়ে দিয়ে– ভালো থেকো
দুঃখ ভুলে, আপন প্রেমের আঙুল ছুঁয়ে সুখেই থেকো
মগ্ন কোনো শীতের রাতে পড়লে মনে
জানিও কেবল, তাতেই হবে
ভুল জীবনের আর্তনাদে, আমার সকাল অন্ধ হলেও

তোমার স্মৃতির ডাক পাঠাবো, জেনে নিও…

১২.

অন্ধকার জানু পেতে বসেছিলো কা’র ইশারায়
সবাই হারিয়ে যায়, মুখোশের দিনলিপি যতো
আকাঙ্ক্ষা পোড়ায় শুধু, না পাওয়া খুঁটে খুঁটে খায়
আপন ছায়াও জানে না, ছুটে যাই অন্ধের মতো।

বহুদিন ধরে আছি, এরকম যত্নের অভাবে
রূপকথা রূপ নিয়ে কেউ তবে আসবে না জানি
বুকে নোনা জল, তবু মুক্তা বুনি ঝিনুক স্বভাবে
ক্ষয়ে যাই শতরূপে–অযত্নে পড়ে থাকা খোসাটি।

তবুও তো স্রোত ভাঙে, মাঝরাতে প্রবল সহগে
আদিম রতির প্রেমে–শরীর যেভাবে শান্ত হয়
জেনেছি প্রবল জ্বরে, সিক্ত লোমকূপ কেন জাগে
পৃথিবীর অন্ধকারে সেই সব সুর, তাল,লয়।

তবুও তো ভালোবাসি, বানভাসি একটা জীবন
সিঁকি-আধুলির মতো হাত পেতে যতকিছু পাই
তাকে তো ঈশ্বর মানি–হয়ে উঠছি বন্যাপ্রবণ
গ্রহণের দ্বারে দ্বারে তাকেই বারে বারে সাজাই।

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Written by
সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Join the discussion

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
সৈয়দ সাখাওয়াৎ

সৈয়দ সাখাওয়াৎ

জন্ম ৮ আগস্ট ১৯৭৮; চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।