সব গান থেমে গেলে

সব গান থেমে গেলে

সৈয়দ সাখাওয়াৎ


১.

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত্রি যখন মধ্যযামে এলো
মন খারাপের নাও ভাসিয়ে কোন সুদূরে বলো–
যাবে তুমি?–জানে না ভীষণ বৃষ্টি জমা মেঘও
স্পর্শ গান থেমে গেলে হায়,থেমে যায় অভিষেকও
অথচ জীবন খুঁজে ফিরে এক চির বহমান নদী
সেইসব শ্রুতি এখনো সজীব, জ্বলছে নিরবধি
অস্ফুট স্বর এখনো বাজে, ধাতুফলকের মতো
যেন বলে যায় আমাদের কথা, আসেনা বসন্ত
আসেনি কোথাও, সময় ফুরায়–সকল নিষ্ফলতা
প্রবল মূহুর্ত হারিয়ে গ্যাছে অলকের স্বাধীনতা
পরস্পরের দুঃখ জমে নীল হয়ে ওঠে জল
থেমে যায় বুঝি সময়ের ঘড়ি, অনন্ত কোলাহল…

২.
চলে গেলে সমস্ত পথ পরিত্যক্ত মনে হয়,
অথচ অন্ধ বধির মানুষটিও জানে—
কত সশব্দ এই শহর,
কত শব্দের উল্লাস জমে ওঠে ফিরতি পথে।

প্রতিটি সন্ধ্যা মরমে বেজে ওঠে,
বিচ্ছিন্ন আলোর নিচে এই শহর হারিয়ে গেলে—
বাতাসের বুকেও কেমন যেন বিষাদের সুর—
শূন্যতায় মিশে যায় সকল বিহঙ্গ গান।

পথের কোন বাঁকে থেমে গেলো—
আমাদের নীরবতা ও ঐশ্বর্যের নদী…
সন্ধ্যার হারিয়ে যাওয়া হাওয়াদের স্বরে—
কত কত শব্দের প্রতিধ্বনি—কেমন খাঁ খাঁ করে…

৩.
এই অর্থহীনতার পাশে, তুমি ডানা মেলে এসে—
আমার ভেতরে এঁকে দিলে দীর্ঘ কোনো এক ছায়া।
তবু সব পথ রুদ্ধ, বৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে থাকে
সজীবতাহীন রুক্ষ মাঠের ভেতর আমি একা
প্রবেশ দরজাগুলো, উড়ছে আমার চারপাশে
রক্তক্ষরণের ছাপ—অস্পষ্ট—স্মৃতিরা অগোছালো।

আমি দুঃখের থেকে বাঁচাতে গেছি নতুন দুখে,
নিজেই হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেছি জ্বলন্ত ছাই
তুমি শূন্যে ভাসমান এক বিষণ্ণ আলোর শিখা, আঙুলের প্রতিবেশী হয়ে, তবু বহুদূরে যেন।

অন্ধকার কখনোবা গান হয়ে আসে শীত রাতে,
তোমার ছোঁয়ায় মেঘ পাথর হয়ে ভেঙে পড়বে
পৃথিবীর বুকে জেগে ওঠে  মাতাল অস্বস্তি—ঢেউ
শিলাগুল্মের ভেতর যদি আবারও ফিরে আসো…

৪.
আমার ব্যথার মাঝে লীলা জেগেছিলো বারোমাস
ছুঁয়ে দ্যাখি শরীরের প্রতি ভাঁজে জেগে থাকা নদী
তুমি যেন শালবন, আঙুলের অবাধ আবাস
ক্রমে উন্মোচিত হয়–ত্বক ও রোমকূপ অবধি
আত্মহননের সুরে জল হয়ে নেমে যায় তবু
সময় ফুরিয়ে যায়–পৃথিবীর সমস্ত আঁধার–
আরও গাঢ়, আরও মৃদু হয়ে ওঠে বৃষ্টিবিন্দু
যেন তোমাকেই ছুঁয়ে, আড়ালে ঢাকিনা কিছু আর
আমার বুকের কাছে নেচে ওঠে যেন রক্তিমাভা
জানি, এ’জল ক্রমশ তলিয়ে যাবে দূর ভাটিতে
এবং একাকী হবো, ফিরে আসে এই সম্ভাবনা–
ক্রমে ক্রমে টের পাই, সমগ্র হারানো এই শীতে…
৫.

কতটা নিকটে এলে তবে কাছে থাকা বলা যায়
কতটা দুখের কাছে জল হয়ে নেমে আসে নদী
এই সন্ধ্যামগ্ন গান, এই হু হু বাউল বাতাস–
সবকিছু পার হয়ে কেবল কাছে পেতে চেয়েছি।
ইচ্ছেগুলি পুড়ে যায়,  অপেক্ষায় ও চির বিরহে
জানি, এইসব দিন পেরিয়ে তুমিও যাবে দূরে–
নক্ষত্র জ্বলা সন্ধ্যায় কিঙবা এই দিনগুলেতে
কেউ কী বুঝতে পারে চোখ থেকে কত আলো ঝরে?

৬.
আমাদের প্রেম তবে ফুরিয়েছে অকূল যাত্রায়
দুই দিগন্তের পারে– সংসার সমুদ্র ভেলায়
যেখানে জমছে ধূলো, অমীমাংসার হাওয়ারা–
মাঝে মাঝে দুলে ওঠে–ছিন্নপ্রেমে–চেনা মুখে যারা
অভিশাপ নিয়ে আসে, অচেনা হয়ে ওঠে ক্রমশ
তুমুল অস্বস্তি নিয়ে বলি–ভালোবাসো!ভালোবাসো!
অথচ জানি, জীবন– এককোষী প্রাণীদের মতো
এই সূর্যালোকে, করে নিজেকে ব্যবচ্ছেদ নিয়ত
আমি যেন তাদেরই নামে গোত্রভূক্ত হয়ে পড়ি
নক্ষত্র ফোটার মতো ছড়িয়ে পড়ি প্রতিবারই
আমাদের প্রেম তবু রৌদ্রকরোজ্জ্বল কোন দিনে
তুমুল প্লাবন হয়ে ছড়িয়ে যাবে প্রতি শ্রাবণে…

৭.
প্রতিটি সকাল আসে, মুখ থেকে মুছে যায় গ্লানি
দয়িতা, তোমার প্রেম–আমাকে নিয়ে যায় সুদূরে
তোমাকে পাই না আর, কেবল জলের দীর্ঘ স্রোতে–
ভেসে ভেসে চলে যাই, দিকশূন্য-অকূলপাথারে
তুমি এসে ভোরবেলা ঘুমভাঙা কণ্ঠের আদরে
কবে ডেকেছো, তোমার হাতে কবে ছুঁয়েছো ভীষণ
সেইসব শীৎকার–শব্দগান হয়ে বেজে ওঠে
তোমার অভাবে দ্যাখো, লেগেছে–চির সূর্য গ্রহণ
জানি, নক্ষত্র ও চাঁদ জ্বলা আকাশের সীমানায়
সন্ধ্যার নদী যেখানে স্রোত ঠেলে নিকটেও আসে
যেখানে শরীর জাগে, পরস্পরের নিকটে এলে
তোমার শূন্যতা যেন গাঢ় হয়ে কাছে এসে বসে…

৮.
আমাকে শেখাও তুমি গ্রহণের এই জটিলতা
বুকের ভেতর পুষে রাখা খরস্রোতা এক নদী–
কী করে শীতল রাখি, অথবা তোমার নীরবতা
এই জলভার, এই নিদ্রা ও জাগরণের বিধি
অথচ এই শরীরে এখনো বিস্মরণের গান
কুয়াশায় ঢেকে পড়া পূর্বপাথরের যতো স্মৃতি
তুমি যেন জেগে ওঠো, যেন মৃদুলা ভাষার টান
ঠোঁটের গাঢ় বিষাদে থামে আমার চোখের জ্যোতি
তবুও কি মনে পড়ে হৃদয়ের এপার-ওপার?
নীল হয়ে ওঠা জলে কতটুকু বিষাদ জমেছে
নিষেধের কথকতা অথবা তৃষ্ণার বুনো ভার
কতটা কাঙাল করে, ঠেলে দ্যায় মৃণালের কাছে…

৯.
অথচ বাক্সবন্দী এই শহরে–
আমার হৃদয়ে তবু, নিভে যাওয়া আলো
ছুটে আসে– যেভাবে তুমিও আসো
দূর কোনো নক্ষত্রালোক থেকে
চলে গেলে–
কিছু গুঞ্জন ধ্বনি বাতাসে তবু থেকে যায়

যেন সময়ের চিহ্ন, স্মৃতির ভার–
শব্দজড়তা থেকে উঠে আসে আর বলে–
তবে কিসের মানে খুঁজব? কিসের কথা বলব?
তোমার পথচলা যেন রেখে যায় ক্ষীণ ছাপ,
ধীরে ধীরে ঢেকে যায় বিস্মরণের কুয়াশায়

তবুও, সেই স্মৃতির ছোঁয়া থেকে যায় কোথাও,
তবুও হৃদয়ে জাগে এক অদ্ভুত প্রতিধ্বনি—
যার গভীরতায় বুঝি—তোমার মতন কিছু নেই,
তোমার মতন কেউ নেই, কেউ নেই কোনোখানে

১০.
শরীর নিবৃত্তি পায়, ফুরায় সকল আয়োজন
দূরে চলে যাও তুমি–হাওয়ায় পাতাদের গান
এই কি চেয়েছি; নাকি অন্যকিছু–আমাদের মন–
যেকোনো শব্দের জ্বরে ভেঙে পড়ে স্নেহের পুরাণ

আমার হাতে এখনো জড়িয়ে আছে গাঢ় নিশ্বাস
চোখের আলোর নিচে শেষ বিকেলের মৃদু ছায়া
আমার বুকের কোণে তবু জমে অগাধ আশ্বাস
যেতে চেয়ে কাছে–কেন যে কখনো যাওয়া হয় না

তবুও প্রবল ভাষা মনে করে কাছে ডেকো প্রিয়
নক্ষত্র ঝরার রাতে তুমিই মনে পড়ো এখনো…

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Written by
সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Join the discussion

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
সৈয়দ সাখাওয়াৎ

সৈয়দ সাখাওয়াৎ

জন্ম ৮ আগস্ট ১৯৭৮; চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।