শরশয্যা

শরশয্যা

সৈয়দ সাখাওয়াৎ


নীরব ব্যথার দিন, তুমি আসো আলুথালু সাজে
চোখের পাতায় তার নীরব অস্বস্তি লেগে আছে
মাটির গভীরে যেন সেইসব সুরগুলো বাজে
সূর্যের গ্রহণে গাঢ় অন্ধকার যেনবা নেমেছে।
যেদিকে তাকাই এই রৌদ্রদগ্ধ দিন ফিরে আসে
হাড়ের গভীরে লেগে আছে সেইসব অপমান
কবন্ধ শরীর ছুটে যায়–প্রিয় রাত্রি ভালোবেসে
অক্ষর হারিয়ে যায়, স্মৃতি হয় ক্রমে ক্রমে ম্লান।
সবুজ ধানের খেতে, নিঃসঙ্গ শিষ বেজে ওঠে
নতুন পলিতে জাগে বীজ–যেন শরীরের ওম
কামনা জেগেছে তাই, ছুঁয়ে স্ফুরিত তোমার ঠোঁটে–
আঁকি নৈঃশব্দ্য কণা, আঁকি আলোকের উদগম।
তোমার উষ্ণ শরীর,  ছোঁয়ার মাধুর্য মেনে ছুঁই
প্রতিটি মুহূর্ত তাই, বাজছে তানপুরার মতো
প্রেম তবু স্থায়ী নয়, যেন এক পুরনো সাঁকোই–
ভেঙে পড়ছে সহসা, সম্পর্ক বুনে যাই যতো!
হৃদয় অশান্ত হলে, ভালোবাসা দূরগামী হয়
একাকী পথিক যেন, ফিরে যায় অনিচ্ছায় ঘরে
সংসার সেঁচে নেয়, শরশয্যায় তবুও রয়–
অনিচ্ছুক দিন থেকে, আলো আসেনা তার শিয়রে।
২.
প্রেম তবু গাঢ় হয়, ভেজায় শরীর, রাগ, লজ্জা
বিরহ যাকে ছুঁয়েছে তাকে ঘিরেছে সীমানা এক
মৃত্যু ফেরাবে না তাকে, শয্যা তবু হয়না তো শয্যা
বেঁচে থেকে তার নাম মুছে যাবে তৃষ্ণার চাতক
অন্তিম দুঃখ ছুঁয়ে বসে থাকে নামহীন পাখি
ডেকে ওঠে ক্ষীণস্বরে,  যেন নামে ঘুমের ইশারা
যেন অস্ফুট শব্দের ভার– নৈঃশব্দ্য নেমেছে কি?
অন্ধ চোখ নিয়ে বেঁচে ছিল শব্দজ্বরাক্রান্ত যারা
এই দুঃখ যেনবা গাঢ় হয়, উষ্ণ হয়ে ওঠে
আমাদের কামনায়–জলের  মতোন নেমে আসে
প্রতিটি মুহূর্ত তার লেগে থাকে সুরে– লীন কন্ঠে
আড়ালে ঢেকেছে সব, যারা ছিলো প্রবল প্রকাশে!
৩.
এই উষ্ণতাহীনতা, এই বাষ্পবন্দী গাঢ় দিন
প্রতিটি মূহুর্ত যেন ক্রমে ক্রমে হয়ে যায় লীন
প্রাচীন কোন গহ্বর থেকে আসে দুঃখরেখারা
সকল দুয়ার খুলে, বেরিয়ে আসে উদ্বাস্তু যারা–
হৃদয়ের কাছে ঋণী, যেন আলস্যে ভরা আঁধার
ভেঙে পড়া পাথরের শয্যায় দ্যাখেছি বাস্তুভার
ফিরে আসে ঘর থেকে ঘরে, যেন হারানোর গান–
গেয়ে যাবে প্রেমহারা–বুকে জমে ফসিলের ঘ্রাণ
বালিঘর বুঝি তার গড়েছিলো এ’ অচলায়তন
জ্যোৎস্নাবিহারে যাবে, আমাদের ব্যথার কাঞ্চন
সেদিন–মথুরা প্রেমে কে হবে রাধিকার নয়ন?
বাঁশিটি বেজেছে যার, তার বুকে অবুঝ ক্ষরণ!
৪.
এমন সকাল যদি নেমে আসে অন্ধের ছায়ায়
যতদূর চোখ যায়–দ্যাখি শুধু আদি নশ্বরতা
এপিটাফে লেখা হয়: চেয়েছি শুধু কারো মায়ায়–
থেমে যাক কোলাহল আর আত্মহননের কথা!
কোথাও ছিলাম শুধু আলগোছে ছায়াদের ভীড়ে
প্রবীন নক্ষত্র ক্রমে পুড়ে পুড়ে ধুমকেতু হয়
তোমার চোখের পাশে অনিদ্রায় লীন অহঙ্কারে
আমার নাম কি ছিলো? জানি না–অবুঝ সংশয়
হৃদয়ের গান জানে, তুমি রবে নাক্ষত্রিক ভোরে
কোমল মায়ার সুরে, র’বে অমীমাংসার রোদে
আমার কথা না হয়, না বাজলো বুকের গভীরে
শরশয্যায় কাটুক এক জীবন, চির বিচ্ছেদে…
৫.
সময় ফুরিয়ে যায়, তুমিও ফুরিয়ে যাও যদি
অনন্ত এ’কোলাহলে, নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার
সমস্ত আশাহীনতা, যেনবা অনন্ত এক নদী
আমার ঐশ্বর্যে তুমি ফিরে ফিরে আসো বারবার
তুমি শিল্পের মৌসুম–তুমি যেন অন্য কোলাহল
প্রতি মূহুর্তে বুঝিবা তার আরাদ্ধ সঙ্গীত বাজে
যেন এই না থাকার সুরে ঝরে পড়ে এতো জল
সে চলে গ্যাছে এমন মায়ায় বেঁধে নীল ঐশ্বর্যে
যারা চলে যায়, তারা যেন বুকের গভীর ওম
দ্যাখা হয়নি বলেই হয়তো অনন্ত সে জ্বলছে
রেখে অনন্তর প্রেম–ফিরে আসে জনম জনম
অস্থির দিনগুলোতে–প্রিয় ব্যথার কথা বলছে…
৬.
আমি আছি, বেঁছে আছি যেনবা মৃতদেহের হিমে
প্রতিটি মূহুর্ত তাই মনে হয় পাথর শীতল
চোখ থেকে ঝরে জল, চির আলোকের মওসুমে–
হারিয়েছে ভাষা যার, বুকে তার এতো কোলাহল!
অথচ হাতের কাছে ছিল চির বাসনার নদী
জেগে উঠেছিল দীর্ঘ বাহু ছড়িয়ে সন্ন্যাসী মেঘে
ছুঁয়ে তোমার কপাল, উষ্ণভার–শরীর অবধি
আমি যেন ছড়িয়েছি পাতাদের ঝড়ে পড়া দ্যাখে।
গভীর চোখের পাতা, বানভাসি হৃদয়ের টানে
বীজের শরীর থেকে এপিটাফের নগ্ন অক্ষর–
সবকিছু ঝরে যায়, শুধু সন্ধ্যা আরতির গানে
বেঁচে থাকে স্মৃতি আর ফুরিয়ে যাওয়া কন্ঠস্বর।
৭.
যতদূর দৃষ্টি যায়, এই পাতাঝরা অন্ধকারে
যা কিছু চেয়েছি এই অবধি– ঝরে যায় নীরবে
ফিরে আসুক সে; সুরে–নিসঙ্ক হৃদয়ে–অহঙ্কারে
হাওয়ায় হাওয়ায় পাতারা বাজে এ’অসম্ভবে।
বেঁচে যে ছিলাম, তবু ডেকে বলি এইসব কথা
প্রেম নয়, চাই শুধু অনঘ সম্পর্কের আঘ্রাণে
জলের শরীরে তাই গেঁথে গ্যাছি প্রিয়–সরলতা
জেনেছি হৃদয় তবু–কেঁপে ওঠে এখনো উজানে।
মাটিও নেবে না আর, নেবে না বীজের উদগমে
তোমার সীমান্তরেখা আমাকে করে তোলে একাকী
কেন পাথরে ঢেকেছো? শরশয্যায় তীব্র মরমে–
আমার হৃদয়ও কি ক্রমে হয়ে ওঠে বাষ্পবন্দী?
৮.
কেন ডেকে শুনিয়েছো এই অনাদিকালের গান
স্পর্শে কাঁপছি আজও, যেন অনন্ত ভাস্কর্য এক
তোমার আঙুলে বুঝি এখনও সেই উপাখ্যান
লিখেছে নক্ষত্র দিনে, পাতাঝরা রাত্রির কোরক
এসব কথা কখনো পৌঁছাবে হিমরাত্রি পেরিয়ে
অচেনা নদীর তীরে, নিশ্চুপ জংলার কিনারে
ব্যথার প্রদীপ জ্বালা সন্ধ্যার মসৃন গায়ে গায়ে–
তা-ও নয়, শুধু এক বঞ্চিতের স্মৃতি মনে পড়ে
শরশয্যার ব্যাকুল অন্ধকারে–যে তুমি রেখেছো–
শীতের চাদরে মোড়া কয়েক লক্ষ নিকষ রাত
তার কাছে যাই, ছুঁয়ে দ্যাখি কতটুকু দূরে আছো–
শতাব্দীকাল পেরিয়ে–বাড়িয়ে রেখেছি দুটো হাত…

এপ্রিল, ২০২৪

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Written by
সৈয়দ সাখাওয়াৎ
Join the discussion

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
সৈয়দ সাখাওয়াৎ

সৈয়দ সাখাওয়াৎ

জন্ম ৮ আগস্ট ১৯৭৮; চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।